মৃত্যুর আগে ও পরে শাহাব উদ্দিন’র পাশে ছিল পরিবার-ইউএনও (ভিডিও)

আপডেট : June, 5, 2020, 10:20 am

সিদ্দিক আল-মামুন

ফেনীর সোনাগাজীতে করোনা আক্রান্ত শাহাব উদ্দিনের মৃত্যুর সংবাদ, পরিবার ও জনপ্রতিনিধির বক্তব্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এলাকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড়।

জানা যায়, গত ৩১মে রোববার রাতে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মতিগঞ্জ ইউনিয়ন এর শাহাব উদ্দিন আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তার মৃত্যুতে পরিবার ও মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সুনামধন্য প্রথম সারির ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক আকারে প্রকাশিত একাধিক মিডিয়ার খবরে উল্লেখ করা হয়-
সোনাগাজীতে পরিবারের অমানবিক-নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হয়ে মারা যান করোনয় আক্রান্ত শাহাব উদ্দিন।
তিনি চট্টগ্রামের একটি পাম্পের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় অসুস্থতা অনুভব করলে সোনাগাজীর বাধাদিয়া গ্রামে নিজ বাড়িতে আসেন, কিন্তু বাড়িতে আসার পর পরিবারের সদস্যদের অমানবিক আচরণের শিকার হন তিনি,
ঘরের গিয়ে রুমে প্রবেশ করার পর বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে নিচতলার একটি রুমে আটক রেখে পরিবারের সবাই চলে যান দোতালায়। উল্লেখিত নিউজে এলাকার লোকজনের ভাষ্যমতে শাহাব উদ্দিন বন্দি থাকা অবস্থায় সেখানেই তিনি অনাহারে কষ্ট করে মারা যান। চিৎকার-চেঁচামেচি করে এক গ্লাস পানিও পান নি তিনি।

পরবর্তীতে মিডিয়ায় বক্তব্য দান কারীদের দাবি , মৃত শাহাবুদ্দিনের লাশ উদ্ধার সময় আশপাশের লোকজন সহ পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি, তছনছ অবস্থায় একটি কক্ষে উলঙ্গ অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে, পরিবারের কাছে একটু পানি চেয়েও পাওয়া যাইনি। এমনকি জানাজায়ও অংশগ্রহণের জন্য স্বজন ও পরিবারের কোন লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি।

“এলাকাবাসী ও দেশ-বিদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিবারটির প্রতি তীব্র ক্ষোভ আর নিন্দার ঝড় বয়ে চলছে”

এমন সংবাদের ভিত্তিতে আলোকিত সময় একটি অনুসন্ধানী টিম মৃত শাহাব উদ্দিনের বাড়িতে গেলে তার মা হাফিজা খাতুন জানান, একে’তো ছেলে হারালাম তার উপরে এত বড় অপবাদ এটি সহ্য করার মতো না, আমার ছেলে মারা যাওয়ার আগে ও পরে এক মিনিটের জন্য আমরা কোথাও যায়নি, সারাক্ষণ ওর পাশে ছিলাম।
স্ত্রী নাহার আক্তার জানান, আমার স্বামী অসুস্থতা অনুভব করলে ২৯ মে শুক্রবার বাড়িতে আসেন, পরের দিন ৩০ মে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে ১৫৭ নাম্বারে করোনার পরীক্ষা জন্য স্যাম্পল দিয়ে আসি, আমি ও আমার জামাতা এবং ছেলে।
তারপরের দিন ৩১মে রবিবার রাত ৮:৪৫ দিকে ঔষুধ খাওয়ানোর জন্য নিজ হাতে পাওয়া রুটি খাইয়ে দিই। এ সময় আমার শাশুড়ি ছেলে সহ আমার ছোট ঝা একই রুমে ছিল। ৫/৭ মিনিটের মধ্যে উনি কথা বলা বন্ধ করে দিলে আমরা কান্নায় ভেঙে পড়ি, তার কিছুক্ষণ পর আমার মেয়ের জামাতা সোনাগাজীর ইউএনও’কে ফোন করে বিষয়টা জানালে তিনি উপজেলা থেকে সরকারের লোকজন পাঠান। উনারা আসার পর আমাদের অন্য রুমে যেতে বললে আমরা পাশের রুমে চলে আসি।

স্বামীকে রেখে পালিয়ে যাওয়ার ও ও বিভিন্ন নিউজ এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা, আমাদের বিয়ের ৩০ বছরে একদিনের জন্য আমাদের কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয়নি! মৃত্যুর সময় আমার হাতের উপরে তিনি মারা যান এবং সরকারি লোকজন আসার পরে আমরা ওই রুম থেকে পাশের রুমে চলে আসি।
আমাদের দোতলার কোন রুম নেই, শুধু ছাদ হয়েছে, আমরা নিচেই থাকি।
তাছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক আমাদের সাথে কথা বলেনি, আপনারা যা শুনছেন সবাই বাহিরের গুজব।
উনার দাফনের সাথে সাথে আমাদেরকেও সমাজ ও আত্মীয়-স্বজনসহ পুরো জাতির কাছে দাফন করে দিয়েছে মিডিয়া। আমরা প্রশাসনের কাছে এর একটি সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার চাই।

মৃত শাহাব উদ্দিনের মেয়ের জামাতা মোহাম্মদ সেলিমের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমার শশুরের জন্য কাফনের কাপড় আনা, কবর খোড়ার ও লাশ দাফনের জন্য কেউ খাট না দিলে চেয়ারম্যান এর সহযোগিতায় খাট নিয়ে আসা সহ সার্বিক কাজে আমার ২ ফুফাতো শেলক ও আমার নবম শ্রেণী পড়ুয়া আপন শ্যালক সৌরভ উপস্থিত ছিলো।

 

কিন্তু দুঃখের বিষয়, মিডিয়া কোথায় থেকে এসব তথ্য ফেলো ? কেনইবা এমন নিউজ করল আমরা কিছুই জানি না।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রবিউজ্জামান বাবুর সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমি খবর পেয়ে সাথে সাথে ইউএনওর নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা থেকে পিপিই আনায়ন থেকে শুরু করে উপজেলা প্রশাসনের কাফন-দাফনের টিমের সাথে সর্বাত্মক থেকে কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করি। মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মৃত ব্যক্তি কে রেখে পালিয়েছে পরিবার-একথা সত্য নয়। মিডিয়াতে যারা ভুল তথ্য দিয়ে পরিবারটিকে সমাজের কাছে হেয়পতিপন্ন করেছে এটি নিঃসন্দেহে ঘৃণিত কাজ। মিডিয়ার সম্প্রচারিত আমার বক্তব্যটি খন্ডিত অংশ, আমার দেয়া পুরো বক্তব্যটি শুনার পর সকল ভুল ব্যাখ্যার অবসান ঘটবে।

সোনাগাজী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ সাজেদুল ইসলাম জানান, মৃত শাহাব উদ্দিনের মৃত্যুর পর “পরিবার পালিয়ে যাওয়া সংবাদটি গুজব। গুজব ছড়িয়ে এলাকার আইনশৃঙ্খলা অবনতি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে জনপ্রতিনিধিসহ সকলের প্রতি আহ্বান জানান। ইচ্ছাকৃত কেউ এমন গুজব ছড়ালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে বলেও জানান তিনি।

সোনাগাজী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা অজিত দেব জানান, মৃত শাহাব উদ্দিনের মৃত্যুর ঠিক ১০ মিনিটের মধ্যে উনার নিকট আত্মীয় আমাকে ফোন করে জানানোর পরে আমি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি’কে জানাই, পরবর্তীতে উপজেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও ইসলামী আন্দোলনের সদস্যদের টিমকে মৃত ব্যক্তির কাফন- দাফনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার জন্য সার্বিক তত্ত্বাবধান করি। সোনাগাজীর ওসি ও স্থানীয় চেয়ারম্যান’র সহযোগিতায় করোনা নির্দেশনায় সরকারি সকল প্রকার বিধি-বিধান মেনে কাফন দাফনের কাজ সম্পন্ন হয়। পরের দিন আমি নিজেই নিহতের বাড়িতে যাই এবং পরিবারের সদস্যসহ স্বজনদের সাথে কথা বলে ও তদন্ত টিমের মাধ্যমে জানতে পারি শাহাব উদ্দিন এর মৃত্যুর আগে ও পরে পুরোটা সময় ধরে তার পরিবারের লোকজন তার সাথে ছিল মর্মে তদন্ত টিমের মাধ্যমে জানতে পারি।

সোনাগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন জানান, এমন ঘটনা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। একটি ভুল তথ্যের জন্য শুধু ঐ পরিবার নয়, পুরো সোনাগাজী তথা ফেনী বাসী আজ কলঙ্কিত। যারা মিডিয়াকে ভুল তথ্য দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করেন।

ফেনী জেলা প্রশাসক মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান জানান, সরকারি নির্দেশিত বিধান মতে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির জন্য উপজেলা পর্যায়ে ইসলামী ফাউন্ডেশন ও ইসলামী আন্দোলনের সমন্বয়ে যৌথ টিম করা হয়েছে।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যাপ্ত সেফটি নিয়ে করোনয় আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ দাফন করা টিমের দায়িত্ব। এখানে পরিবারের সদস্যরা তখন হোম কোয়ারেন্টাইন থাকা বাধ্যতামূলক। জানাযায় কিংবা দাফন-কাফনে পরিবারের সদস্য অংশগ্রহণ করার সুযোগ নেই।