বিকাশের আড়ালে হুন্ডি ব্যবসায় যুবলীগ নেতা রাজীবের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি-

আপডেট : May, 9, 2023, 4:28 pm

বিকাশের আড়ালে হুন্ডি ব্যবসায় যুবলীগ নেতা রাজীবের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি-

অনলাইন ডেস্ক:

ফেনী জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) চৌধুরী আহমেদ রিয়াদ আজিজ রাজীব। বনিটো কমিউনিকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। এ প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) বিকাশের জেলা ডিস্ট্রিবিউটর। রাজীব ও তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ৪৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে গত এক বছরেই তার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৯২৫ কোটি টাকা। বিপুল এ অর্থের ৯৯ শতাংশই জমা হয়েছে নগদ টাকায়। এ নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা হওয়া এবং বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটরশিপের আড়ালে ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বিপরীতে লেনদেন হয়েছে বলে সন্দেহ করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ তথ্যের ভিত্তিতে অধিকতর অনুসন্ধান শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

 

 

অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত বিএফআইইউর একাধিক কর্মকর্তা জানান, বনিটো কমিউনিকেশনের মালিক চৌধুরী আহমেদ রিয়াদ আজিজ রাজীবের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্বাভাবিক নয়। প্রতিষ্ঠানটি হুন্ডি তত্পরতার সঙ্গে যুক্ত। অন্তত ৩৪৬ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে বলে বিএফআইইউ প্রমাণ পেয়েছে। এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পাঠানো হয়েছে।

চৌধুরী আহমেদ রিয়াদও স্বীকার করছেন তার ও নিজ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ৪৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। এ যুবলীগ নেতা বলেন, ‘কুমিল্লার পর ফেনী ও নোয়াখালীতে প্রবাসী বেশি। তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বেশি। কোনো প্রবাসীর টাকা যদি ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে এসে থাকে, সেটা আমাদের পক্ষে নির্ণয় সম্ভব নয়। তবে লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থ পাচারের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

ডলার সংকটের মধ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ডিজিটাল হুন্ডি চিহ্নিত এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সমন্বিত অভিযানে নামে বিএফআইইউ ও সিআইডি। সেখানে উঠে আসে ফেনীর বনিটো কমিউনিকেশনের মালিক চৌধুরী আহমেদ রিয়াদ আজিজ রাজীবের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য। এক্ষেত্রে রাজীব এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে তফসিলি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আটটি ব্যাংকে ১০টি হিসাবের লেনদেন পর্যালোচনা করা হয়। সেখানে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা জমা এবং সমপরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

এর মধ্যে ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত তার ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ৯২৫ কোটি টাকা। এ টাকার ৯৯ শতাংশই নগদ টাকায় জমা করা হয়। এর বিপরীতে ই-মানি সংগ্রহ করা হয় ১ হাজার ২৮২ কোটি ৪৯ লাখ টাকার। পরবর্তী সময়ে ফেনী অঞ্চলের ১ হাজার ৮১৬ জন এজেন্টের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কিন্তু এ ই-মানির বিপরীতে চেক, আরটিজিএস বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং মাধ্যম ব্যবহার না করে নগদে টাকা পরিশোধ করা হয়। সেক্ষেত্রে ডিস্ট্রিবিউটর হাউজ থেকে নেয়া ই-মানি এজেন্টদের মাধ্যমে হুন্ডি ব্যবসার উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হতে পারে মর্মে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করেন আর্থিক গোয়েন্দারা।

রাজীবের ব্যাংক হিসাবের তথ্য পর্যালোচনা করে তৈরি করা অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, বনিটো কমিউনিকেশনের কর্মচারী মাহমুদুল ইসলাম, এনামুল হক, শহীদুজ্জামান বোরহান, সম্রাট, নিশান ও আশিকের মাধ্যমে ৩৭৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা সাউথইস্ট ব্যাংকের ফেনী শাখায় জমা করা হয়। এর মধ্যে শুধু মাহমুদুল ইসলাম একাই জমা দিয়েছেন ৩৪৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। একইভাবে ঢাকা ব্যাংকের হিসাবে ৫ লাখ টাকার ওপর ৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা জমা করা হয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ফেনী শাখায় ৫ লাখ টাকার ওপর জমা হয়েছে ১২৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এনআরবিসিতে ৫ লাখ টাকার ওপর ১২৭ কোটি টাকা জমা করা হয়েছে। এভাবে এক বছরে রাজীব ও তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৯২৫ কোটি টাকা জমা হয়। তার ডিস্ট্রিবিউটর হাউজের এজেন্ট মা-বাবা স্টোর, ইসলাম অটো, ইউসুফ মেডিসিন কর্নারসহ ৪৬টি এজেন্টের মাধ্যমে বড় অংকের নগদ লেনদেন হয়েছে।

অনুসন্ধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত আর্থিক গোয়েন্দারা বলছেন, এমএফএসের মাধ্যমে ডিজিটাল হুন্ডির ফলে বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় পাঠান তা বিদেশেই থেকে যায়। সে অর্থ পাচারকারীদের হাতে বিদেশে তুলে দেয়া হয়। আর দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করে, তারা তা হুন্ডি চক্রের হাতে তুলে দেয়। যখন কারো বিদেশে অর্থ পাচারের প্রয়োজন হয়, তখন শুধু ওই অর্থের মূল্য বিদেশে স্থানান্তর হয়। দেশীয় টাকার বিপরীতে বিদেশে ডলার পেয়ে যায় পাচারকারীরা। অবৈধ এ স্থানান্তরের ফলে ডলারের দাম বেড়ে যায়। প্রবাসী আয় যদি বৈধ পথে আসে তা দেশের ব্যাংকগুলোয় ডলার হিসেবে জমা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার এ অর্থ রিজার্ভেও যুক্ত হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘অর্থ পাচার ও হুন্ডির তত্পরতা ঠেকাতে বিএফআইইউ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে বিএফআইইউ নিজে থেকে কারো বিরুদ্ধে মামলা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না। তদন্ত করে আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রতিবেদন পাঠাই। হুন্ডির তত্পরতা রোধে আমরা সারা দেশে ব্যাংকিং চ্যানেল ও এমএফএসের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছি।’

 

তিনি আরো বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকশ হিসাব স্থগিত করেছি। অনেক এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। আমরা প্রবাসীদের হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে নিরুত্সাহিত করছি। হুন্ডির তত্পরতা কমলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। একই সঙ্গে দেশ থেকে অর্থ পাচারও রোধ সম্ভব হবে।’

রাজীব ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আজিজ আহমেদ চৌধুরীর সন্তান। আজিজ আহমেদ চৌধুরী ১৯৯৮ সাল থেকে প্রায় এক যুগ ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তবে রাজীবের মা রোকেয়া বেগম (রোকেয়া আজিজ) ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহিলা দলের অন্যতম সংগঠক।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হলেও ছাত্রজীবনে রাজীবকে সক্রিয় রাজনীতিতে দেখা যায়নি। ২০১৬ সালে ফেনী জেলা যুবলীগের রাজনীতিতে রাজীবের আকস্মিক উত্থান ঘটে। ওই বছরের ২ মার্চ ফেনী জেলা যুবলীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে দাগনভূঞা উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতনকে সভাপতি ও শুসেন চন্দ্র শীলকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়ে যান রাজীব। পরবর্তী সময়ে শুসেন চন্দ্র শীল ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলে রাজীব জেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন।

এক বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার ই-মানি ইস্যু করার বিষয়ে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমার ব্যবসাটাই ই-মানির, এ কারণে ব্যাংক হিসাবে বেশি লেনদেন হবে এটিই স্বাভাবিক। বিকাশ এজেন্টদের থেকে নগদ অর্থ সংগ্রহ করে সে টাকা ব্যাংকের জমা করে ই-মানিতে রূপান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে সে ই-মানি এজেন্টদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এখানে অর্থ পাচারের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এসব ব্যাংক হিসাব থেকে অন্য কোথাও টাকা ট্রান্সফার বা পাচারও করা হয়নি।’

এজেন্টের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে রাজীব বলেন, ‘এমএফএস প্রতিষ্ঠানের নির্দেশনা রয়েছে কোনো এজেন্ট সরাসরি ডিস্ট্রিবিউটরের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা দিতে পারবে না। সেজন্যই আমরা নিজেদের কর্মী পাঠিয়ে টাকা সংগ্রহ করে সেটি ব্যাংকে জমা দিই।’

 

ফেনীর বনিটো কমিউনিকেশনসসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে বলে জানান সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুুন কবির। তিনি বলেন, ‘প্রবাসী আয় অবৈধ পথে দেশে আসার সম্ভাব্য পথগুলোর মধ্যে এমএফএসের মাধ্যমে ডিজিটাল হুন্ডি অন্যতম। এ ধরনের আর্থিক অপরাধ প্রতিরোধে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। এ ধরনের অর্থ পাচারের মতো অপরাধের ঘটনায় এরই মধ্যে ছয়টি মামলা হয়েছে। ফেনীর বনিটো কমিউনিকেশনসসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’